রবি মৌসুমের শুরুতে লালমনিরহাটের বাজারে সার সংকট দেখা দেওয়ায় কৃষকদের মাঝে হাহাকার দেখা গেছে। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে এসেও চলতি মাসের বরাদ্দ সারের ২০-২৫ শতাংশ সার পৌঁছেনি বাফার গুদামে। এ ছাড়া অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কোনোরকম বরাদ্দ দেয়নি বাংলাদেশ কেমিক্যালস ইন্ডাস্ট্রিজ কর্পোরেশন (বিসিআইসি) কর্তৃপক্ষ। ফলে সার সংকটে পড়েছেন চাষিরা। রবি চাষাবাদ নিয়েও দুঃচিন্তা কৃষক পরিবারে।
কৃষকরা জানান, নভেম্বর মাসে রবি মৌসুম শুরু হয়। চলে ডিসেম্বর পর্যন্ত। আলু, ভুট্টা, সরিষা ও গমসহ নানান সবজি চাষাবাদ হয় রবি মৌসুমে। রবি মৌসুমের শুরুতে জমিতে পর্যাপ্ত সার প্রয়োগ করেন চাষিরা। ফলে রবি মৌসুমে সারের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। বর্তমানে কৃষকরা রবি ফসল বুনতে ব্যস্ত সময় পার করছেন। মৌসুমের শুরুতে চাহিদা মত সার ন্যায্যমূল্যে না পেয়ে অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েছেন চাষিরা। চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় কোথাও কোথাও অধিকমূল্যে সার বিক্রির অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমান সময় জেলার পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধা উপজেলায় পুরোদমে চলছে ভুট্টা বীজ বুনন কার্যক্রম। বীজ বুননের আগে জমি তৈরি করতে পর্যাপ্ত পরিমাণে সার প্রয়োগ করতে হচ্ছে চাষিদের। সেই মৌসুমে সার সংকট সৃষ্টিতে বিপাকে পড়েছেন এই দুই উপজেলার ভুট্টা চাষিরা। একইসঙ্গে চলছে আলু রোপণের মৌসুম। সবমিলে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় বাজারে সার সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রান্তিক পর্যায়ের কতিপয় অসাধু বিক্রেতা অধিকমূল্যে সার বিক্রি করছেন বলেও অভিযোগ কৃষকদের। যার বেশিভাগই অনিবন্ধিত ব্যবসায়ী। এসব বিক্রেতা মৌসুম শুরুর আগে ডিলারদের কাছ থেকে ক্রয় করে গুদামজাত করে এ কৃত্রিম সংকট তৈরি করে সুযোগ বুঝে বর্তমানে বেশি দামে বিক্রি করছে। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে অধিক দামে সার কিনে চাষাবাদ করছেন। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন চাষিরা।
হাতীবান্ধার ভুট্টাচাষি আসাদুজ্জামান বলেন, ভুট্টা চাষাবাদ শুরু হতেই বাজার থেকে সার উধাও হয়েছে। গোপনে বেশি টাকা দিলে সার মিলছে প্রান্তিক বিক্রেতাদের কাছ থেকে। ডিলাররা সরবরাহ নেই অজুহাতে সার নেই বলেও ফিরে দিচ্ছেন। চাষাবাদ করতে অধিকমূল্যে সার কিনতে হচ্ছে। বাংলা টিএসপি প্রতিবস্তা ১৩৫০ টাকার স্থলে ১৫০০ টাকা এবং বাংলা ডিএপি ১০৫০ টাকার স্থলে দুই হাজার টাকা দামে কিনতে হচ্ছে অনিবন্ধিত বিক্রেতাদের কাছ থেকে। শুরুতে এমন ধাক্কা খেয়ে উৎপাদন খরচ যেমন বাড়ছে তেমনি চাষাবাদ নিয়েও শ্বঙ্কা দেখা দিয়েছে। পর্যাপ্ত সার সরবরাহ নিশ্চিত ও অসাধু বিক্রেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দাবিও জানান তিনি।
আদিতমারীর দেওডোবা গ্রামের কৃষক সাদেকুল ইসলাম বলেন, তামাক চাষ করতে প্রচুর পরিমাণ সার লাগে। শুরুতেই সারের সংকট দেখা দিয়েছে। অনিবন্ধিত বিক্রেতারা বাংলা টিএসপি ও ডিএপি সার বস্তা প্রতি ২০০ থেকে ৬০০ টাকা বেশি দামে বিক্রি করছে। নিবন্ধিত বিক্রেতাদের গুদামে কোনো সার নেই। তারা দাবি করছেন, বাফার গুদামে না কি সার পৌঁছেনি। তাই সংকট তৈরি হয়েছে। কতদিনে বাফার গুদামে সার পৌছাবে? মৌসুম শেষে চাষাবাদ করলে ফলন কম হওয়ারও আশঙ্কা রয়েছে। সার নিয়ে বড় চিন্তায় আছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ডিলার বলেন, লালমনিরহাটের ৫টি উপজেলার ৩টিতে ব্যাপক হারে তামাক চাষ হয়। বাকি পাটগ্রাম ও হাতীবান্ধায় ব্যাপকভাবে চাষ হয় ভুট্টা। তামাক চাষকে নিরুৎসাহিত করতে তামাকের জন্য কোনো সার বরাদ্দ চায় না কৃষি বিভাগ। তামাক চাষেও প্রচুর পরিমাণ সার লাগে। যার বরাদ্দই দেয় না কৃষি বিভাগ। ফলে তামাকের জমির বিপুল পরিমাণ সার সরবরাহ করতে এ রবি মৌসুমে সারের এ ঘাটতি থেকে যায়। চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে বরাদ্দ দেওয়া উচিত।
নিবন্ধিত সার বিক্রেতারা জানান, অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে কোনো সার বরাদ্দ দেয়নি বিসিআইসি। এ ছাড়াও নভেম্বর মাসে বিএডিসি যে পরিমাণ সার কাগজকলমে বরাদ্দ দিয়েছে তার ২০/২৫ শতাংশ সার এখন পর্যন্ত বাফার গুদামে এসে পৌঁছেনি। গুদামে সরবরাহে কম থাকার কারণে বাজারে কিছুটা সংকট পড়েছে। সামনের সপ্তাহে ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দ পৌঁছে গেলে এ সংকট কেটে যাবে। প্রান্তিক পর্যায়ে অনিবন্ধিত কিছু অসাধু সার বিক্রেতা আগাম সার কিনে মজুত করে সুযোগ বুঝে এখন বেশি দামে বিক্রি করছে। অনিবন্ধিতদের মজুতদারির কারণে এ কৃত্রিম সংকট তৈরি হতে পারে। যা মনিটরিং করে দ্রুত আইগত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। তবে সামনের সপ্তাহে সংকট কেটে যাবে বলেও তারা দাবি করেন।
বিএডিসি’র আদিতমারী বুড়িরবাজারের ডিলার ফরহাদ আলম সুমন বলেন, নভেম্বর মাসের বরাদ্দ চলতি মাসের ৩ তারিখে উত্তোলন করেছি। রবি মৌসুমে চাহিদা বেশি থাকায় বিক্রি শেষ হয়েছে। আগামী মাসের বরাদ্দ তুললে সার বিক্রি করতে পারব। ডিসেম্বর মাসের ২/৩ তারিখের মধ্যে ডিসেম্বর মাসের সার পৌঁছাতে পারে। রবি মৌসুমের ব্যাপক চাহিদা আর গত দুই মাস বিসিআইসি এ অঞ্চলে সার বরাদ্দ না দেওয়ায় এ সংকট তৈরি হয়েছে। তবে, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সংকট হয়তো থাকবে না। বিচলিত হয়ে অসাধু বিক্রেতাদের কাছে বেশি দামে সার না কিনে ৫/৭ দিন অপেক্ষা করতে কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রবি মৌসুমের জন্য নভেম্বর মাসে লালমনিরহাট জেলার ৫টি উপজেলা ও দুটি পৌরসভায় বরাদ্দ আসে টিএসপি এক হাজার ৯২৬ মেট্রিক টন, ডিএপি ৩ হাজার ৪১২ মেট্রিক টন, ও এমওপি দুই হাজার ৭০ মেট্রিক টন। যা উপজেলাভেদে ৩০ ও ৪০ শতাংশ সার এখন পর্যন্ত বাফার গুদামে পৌঁছেনি। পর্যাক্রমে আসছে এবং তা ডিলারদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। গত দুই মাসে বিসিআইসি কোনোরকম সার বরাদ্দ দেয়নি। তবে ডিসেম্বর মাসের জন্য বিসিআইসি ও বিএডিসি’র সার বরাদ্দের চিঠি এসেছে। সেই চিঠি মতে ডিসেম্বর মাসে লালমনিরহাটের চাষিরা পাবেন দুই হাজার ৭৯ মেট্রিক টন টিএসপি, ৩ হাজার ৯১২ মেট্রিক টন ডিএপি এবং দুই হাজার ৬৭০ মেট্রিক টন এমওপি সার। ডিসেম্বর মাস পরলেই সার পর্যাপ্ত হবে জেলার বাজারে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. সাইফুল আরেফিন বলেন, গত দুই মাসে বিসিআইসির সার আসেনি এবং নভেম্বর মাসের বরাদ্দের কিছু অংশ এখন পর্যন্ত বাফার গুদামে পৌঁছেনি। যে পরিমাণ আসছে তা তাৎক্ষণিক ডিলারদের মাঝে বিতরণ করা হচ্ছে। সারের কোনো সংকট নেই। কিছু অসাধু ব্যক্তি গুজব সৃষ্টি করে সংকট তৈরি করছে। এসব অসাধু ব্যক্তি ও বিক্রেতার বিরুদ্দে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।
আগামী সপ্তাহে ডিসেম্বর মাসের বরাদ্দে এ জেলায় সারের কোনো সংকট থাকবে না। তাই গুজবে কান না দিয়ে ডিলারদের কাছে কৃষকদের নির্ধারিত মূল্যে সার কেনার আহ্বান জানান তিনি। তামাকের জমির জন্য সারের বরাদ্দ নেয়া হয় বলেও দাবি তার