শখের সড়কবাতি জ্বালিয়েই বকেয়া ৪৩ কোটি টাকা!

রাজকীয় শহরের খেতাবযুক্ত করে প্রকল্পের মাধ্যমে নিজের পকেটভারি করতে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছেন। যে প্রকল্পগুলোর নাগরিক সুবিধার চেয়ে প্রাধ্যান্য পেয়েছে শখ পূরণ! আর সেই শখের রাজকীয় সড়কবাতি জ্বালালেও দেননি বিদ্যুৎ বিল। এতে বকেয়া পড়েছে ৪৩ কোটি টাকা! যা নিয়ে বিপাকে বর্তমান রাসিক প্রশাসক।

নগরবাসী ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, রাজশাহী নগরজুড়ে যে উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালিত হয়েছে, তার অধিকাংশই অপ্রয়োজনীয় ও অবচয়। এসব প্রকল্প থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নয়ছয় হয়েছে। নগরীর প্রধান সড়কে যে বাতি বসানো হয়েছে, তা অপচয়ের উজ্জ্বল দৃষ্টান্তও। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সড়কবাতি একদিকে যেমন ব্যয়ের পাল্লা ভারি করেছে, অন্যদিকে পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ওপরেও নেতিবাচক প্রভাব তৈরি হচ্ছে।
রাসিক সূত্রে জানা যায়, আলোর এই রোসনাই দেখাতে গিয়ে প্রতিমাসে সিটি কর্পোরেশনের নামে ৫০ লাখ টাকার বিদ্যুৎ বিল আসে। এই বিল সঠিকভাবে পরিশোধ না করায় এরই মধ্যে ৪৩ কোটি টাকার বিল বকেয়া হয়েছে।

নগরীতে সন্ধ্যা নামতেই প্রধান সড়কগুলো আলোকিত করা হয় দৃষ্টিনন্দন রাজমুকুট, প্রজাপতি ও ফ্লাড লাইটের মাধ্যমে। ২০১৯ সালে থাইল্যান্ড ও চীন থেকে আনা নানা ডিজাইনের লাইটগুলো জ্বলানো হয়। তবে এর বিদ্যুৎ বিল নিয়ে শুরু থেকেই বিপাকে ছিলো রাসিক। এ কারণে নানা কৌশলও অবলম্বন করেছে। কখনো অর্ধেক রাস্তা অন্ধকার, কখনো একটির পর অরেকটি লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন, আবার কোন কোন রাস্তার সংযোগ দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বন্ধ রাখার কৌশলও অবলম্বন করা হয়েছে। তারপরও বিদ্যুতেও বকেয়া জমেছে ৪৩ কোটি টাকা। যা নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া নগরবাসীর।

নগরবাসী বলছেন, নগরীর প্রধান সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ না করে পকেটভারি করার রাজকীয় প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। যা নগরবাসীর জীবনমানের ওপর ইতিবাচক প্রভাব আনেনি। রাজশাহীর ঘরে ঘরে বেকারত্বের সমস্যা দিনকে দিন তীব্র হয়েছে। আর সাবেক রাসিক মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন অপ্রয়োজনীয় ব্রিজ, রাস্তা আর লাইট বসানোর প্রকল্প বাস্তবায়ণ করেছেন।
ক্যাব রাজশাহীর সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফা মামুন বলেন, খালি চোখে দেখলে শহরের আলোকায়নকে ভালো মনে হবে। কিন্তু এই আলোর পেছনে যে অন্ধকার আছে, তা ভয়ঙ্কর। এই লাইট স্থাপনে সাবেক মেয়র ও তার সহযোগিতারা লুটপাট-দুর্নীতি করেছেন। আবার এই লাইটের বোঝা টানতে গিয়ে রাসিক বা নগরবাসী নাজেহাল অবস্থা। কারণ তারা চলে গেলেও তাদের পাপের বোঝা জনগণের ট্যাক্সের টাকায় শোধ করতে হচ্ছে। এই অতিরঞ্চিত লাইট একদিকে পরিবেশের ক্ষতি করছে, অপরদিকে, ট্যাক্সের বোঝা ভারি করছে। আমার পরামর্শ থাকবে, এই লুটপাটকারীদের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করে এসব বকেয়া পরিশোধ করা হোক।

নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি-নেসকোর ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী জাকিউল ইসলাম জানান, নিয়মিত বিল পরিশোধ না করায় রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের বিদ্যুৎ বিল বাবদ বকেয়া পড়েছে ৪৩ কোটি টাকা।

তবে, সিটি কর্পোরেশনের বর্তমান প্রশাসক ড. দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর বলেন, আমরা এখন প্রতিমাসে বাকেয়ার ৫০ লাখ টাকা করে পরিশোধ করছি। আর আমরা এখন অলটারনেটিভ ওয়েতে লাইটগুলো জ্বালাচ্ছি। বিদ্যুৎ বিল অর্ধেকে নিয়ে আসা হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের দুটা বিষয় দেখতে হবে, এটি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, এটি সুন্দর। কিন্তু পরিমাণ বেশি। একারণে অলটারনেটিভ ওয়েতে চালানো হচ্ছে। এখানে হাই কনজাপশন যেটা সেটা বন্ধ করা হয়েছে। এছাড়া এখান থেকে অবৈধ সংযোগ কেউ নিতে পারবে না। খেলাধুলা বা অন্য যে কিছুই হোক অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ নেয়া যাবে না। ভবিষ্যতে নগর সৌন্দর্য বজায় রাখবো। কিন্তু অপচয় করবো না।

এদিকে, রাজশাহী মহানগরের তালাইমারী থেকে কল্পনা সিনেমা হলের মোড় (স্বচ্ছ টাওয়ার) পর্যন্ত চার লেন সড়কের গার্ডেন লাইট স্থাপন করা হয়েছে। সড়ক ও বাঁধের এই বাতিগুলোর পেছনে সিটি কর্পোরেশনের ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।

সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা যায়, ১২৭ কোটি ৪৯ লাখ ব্যয়ে নগরের কল্পনা সিনেমা হল থেকে তালাইমারী পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করা হয়েছে। সড়কটি প্রশস্ত করার পর সম্প্রতি সড়কের আইল্যান্ডে বসানো হয় ১৩০টি আধুনিক সড়কবাতির দৃষ্টিনন্দন পোল। প্রতিটি খুঁটির মাথায় লাগানো হয়েছে ১৩টি আধুনিক বাতি। এ ছাড়া সড়কসংলগ্ন বাঁধে স্থাপন করা হয়েছে ১৮০টি আধুনিক সুদৃশ্য গার্ডেন লাইটের খুঁটি। প্রতিটি খুঁটিতে আছে পাঁচটি অত্যাধুনিক বাতি।
এছাড়াও রাজশাহী নগরীর বিহাস থেকে নাদের হাজির মোড় পর্যন্ত বিমান সড়ক খ্যাত দৃষ্টিনন্দন সড়কবাতিতে আলোকায়ন করা হয়। এ সড়কে ৫ কোটি ৪৭ লাখ টাকা ব্যয়ে চার দশমিক ৭ কিলোমিটার সড়কে ১৯৮টি পোলে লাগানো হয়েছে ৩৫৬টি এলইডি বাল্ব। নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা মোড় থেকে বিলসিমলা রেলক্রসিং পর্যন্ত চার দশমিক দুই কিলোমিটার সড়কটিতে ১৭৪টি দৃষ্টিনন্দন পোলে গত বছর বসানো হয়েছে ৩৪৮টি আধুনিক এলইডি বাল্ব। এছাড়া মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ উপ-শহর মোড় থেকে দড়িখরবোনা, কাদিরগঞ্জ, মহিলা কলেজ, মালোপাড়া পুলিশ ফাঁড়ি হয়ে সোনাদীঘি মোড় ও মালোপাড়া মোড় থেকে রানীবাজার মোড় পর্যন্ত সড়কে মোট ৯৬টি ডেকোরেটিভ পোলে ৯৬টি দৃষ্টিনন্দন এলইডি সড়কবাতি লাগানো হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *